বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের হাতে চর্যাপদের মাধ্যমে যার শুরু, হাজার বছরে বাংলা ভাষায় রচিত সেই সাহিত্যের বিস্ময়কর বিবর্তন ঘটেছে। এ পথপরিক্রমায় শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বৈষ্ণব পদাবলী, মঙ্গলকাব্য, নাথ সাহিত্য, ধর্মীয় সাহিত্য, লোকসাহিত্য, পুঁথি সাহিত্য, প্রবন্ধ-গল্প-উপন্যাস সমৃদ্ধ গদ্য সাহিত্য, মহাকাব্য, গীতি কবিতা, আধুনিক গদ্য কবিতা ইত্যাদি বিপুল সমাবেশ বাংলা সাহিত্যকে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ করেছে। সাহিত্যের এ বিবর্তনকালে বাংলা ভাষার সৌকর্য, মাধুর্য ও বৈভব চরমভাবে বিকশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের হাতে। আশি বছরের চমকপ্রদ যাত্রায় প্রায় এককভাবে হাজার বছরের পথ অতিক্রম করেছেন রবীন্দ্রনাথ। বাংলা কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, পত্র সাহিত্য ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে বিচরণ করে বাঙালির অহঙ্কার ও আত্মবিশ্বাসকে উর্ধ্বালোকে তুলে ধরেছেন।

যুগে যুগে ভাষার জন্য বাঙালি লড়াই করেছে। বাংলাভাষাবিদ্বেষী সেন রাজাদের আদেশ তুচ্ছ করেছে, তুর্কি-ফার্সির আভিজাত্যের অহঙ্কারকে ঘৃণা করেছে এবং ইংরেজদের দাপটকে পদদলিত করেছে। সর্বশেষ পাকিস্তানিদের চাপিয়ে দেয়া উর্দু ভাষাকে নিজের ভাষারূপে গ্রহণ না করতে প্রাণপণ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। ভাষার এ লড়াইয়ে সাহিত্য একটি প্রধান হাতিয়ার হয়েছে বাঙালি জাতির। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন বাঙালির চিরায়ত সংগ্রাম কালক্রমে রবীন্দ্রনাথের ওপর নির্ভরতার আশ্রয় খুঁজে পায়। ভাষার জন্য লড়তে লড়তে স্বাধিকার চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাঙালি নিজ ভূখণ্ডটি মুক্ত করে তোলে।

পাকিস্তানি আমলে রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করে ভাষার যুদ্ধে ব্রতী হয়ে যেসব অগ্রসর মানুষ দেশের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন, ওয়াহিদুল হক তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা যোগায়। আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি-এ মন্ত্রে উজ্জীবিত বাঙালির কানে কানে কে যেন বলে দেয়, এইতো আমাদের প্রাণের কথা। আর এ গানটিই হয়ে যায় আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। এর পেছনে ওয়াহিদ ভাইয়ের অবদান কম ছিল না। মু্ক্তিযুদ্ধের সময় বাংলার শিল্পীদের সঙ্গে নিয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটে বেড়িয়ে প্রাণিত করেছেন যোদ্ধাদের।

ওয়াহিদ ভাইকে রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ বলা হলেও কোথায় তাঁর পাণ্ডিত্যের অভাব, সেটা বলা একেবারে মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে রেসকোর্স বলতেই পছন্দ করতেন। এখানে বসে ২৩ বছর ধরে কণ্ঠশীলনের কর্মীদের গাছের নাম মনে রাখতে বাধ্য করেছেন। শুক্রবারের সাতসকালে গাছতলায় দেশবিদেশের গল্প, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, সাহিত্য, রাজনীতি, পরিবেশ, নৃতত্ত্ব, সংগঠন ইত্যাদি হাজারো বিষয়ে সাবলীল পাণ্ডিত্য ঝরে ঝরে পড়ত তাঁর কোমল কণ্ঠ থেকে। ১৩৯১ সালে যাত্রা শুরুর দিন থেকে আমৃত্যু এ সংগঠনটির সুখ-দুঃখের সঙ্গে জড়িয়ে থেকেছেন। আবর্তনের প্রায় ৫ হাজার শিক্ষার্থীর মানস গঠনের আদর্শিক কাজটি করেছেন পরম বন্ধুর মতো। বাংলা কবিতা, গল্প, ছড়া, প্রবন্ধ, চিঠি, কাব্য, নাটক, মঞ্চনাটকসহ বাংলাভাষার উৎকৃষ্ট সাহিত্য মুখে মুখে সাধারণের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া ও সারাদেশে একমান বাংলা চালু করার ব্রত কণ্ঠশীলনের। শুদ্ধ উচ্চারণ ও কবিতা আবৃত্তির বিষয়টি প্রাধান্য পেলেও সাহিত্যের বাচিক চর্চা ও প্রসার প্রতিষ্ঠানরূপে এর পরিচিতি ব্যাপক। এখানে প্রদায়ক গুণিনরূপে সুফিয়া কামাল, ড. আনিসুজ্জামান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সন্‌জীদা খাতুন, কবীর চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, শামসুজ্জামান খান, এনামুল হক প্রমুখ; সভাপতির আসনে পটুয়া কামরুল হাসান, শওকত আলী, শামসুর রহমান, কাইয়ূম চৌধুরী, প্রকৌশলী আহমাদুল হাসান এবং প্রশিক্ষক নরেন বিশ্বাস, বিপ্লব বালা, গোলাম সারোয়ার, নরোত্তম হালদারের মতো বহু গুণী ও নিষ্ঠাবান মানুষের সমাবেশ ঘটলেও সবাইকে একটি ভালোবাসার অদৃশ্য সূত্রে গ্রন্থনা করতে পেরেছেন ওয়াহিদুল হক। মানুষকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করার ব্রত অবলম্বন করে বাংলার আনাচে-কানাচে ক্লান্তিহীন ঘুরে বেড়িয়েছেন। গান শেখাতে, অসহায় মানব-মানবীর ক্লেশ উপশমে, কারো একান্ত বেদনা দূর করতে, অতি সাধারণের ব্যক্তিগত আচার-অনুষ্ঠানে যোগ দিতে অথবা কেবল ভ্রমণের উদ্দেশ্যে তাঁকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত বাংলাদেশের সব প্রান্তে। ফলে ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক পর্যায়ে বহু মানুষ তাঁর সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছেন। এ সংযোগ যাদের জীবনে একবারও ঘটেছে, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে প্রাণময় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এ কারণে বাংলাদেশের এবং দেশের বাইরের বাঙালি সমাজে বহু মানুষের আত্মীয় হয়ে রয়েছেন ওয়াহিদ ভাই। কণ্ঠশীলনের মতো বহু সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান বাংলাভাষা, সঙ্গীত ও সংস্কৃতিচর্চার মূল ধারাটিকে সংরক্ষণ করছে তাঁরই প্রণোদনায়। সাংবাদিকতা পেশায় দীর্ঘদিন একনিষ্ঠ থেকেছেন। চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে সংস্কৃতি সাধনায় পরিপূর্ণ আত্মনিয়োগ করার পাও নিয়মিত কলাম লিখেছেন স্বভাবসুলভ নির্ভীক ও ঋজু ভঙ্গিতে। সারাদেশে রবীন্দ্রচর্চায় যোগ্য প্লাটফর্ম তৈরির লক্ষ্যে একটি সাংগঠনিক কাঠামো গঠিত হয় তাঁর উদ্যোগে। সঙ্গীতের যেকোনো ধারায় ঈর্ষণীয় পাণ্ডিত্য ছিল তাঁর। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া ও সঙ্গীত শিক্ষার তেমন কোনো সনদ না থাকলেও এ দুটি ক্ষেত্রেই তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকারে বাধ্য হবেন অনেক পণ্ডিত ও ওস্তাদ। প্রথম আবৃত্তি ফোরাম বাংলাদেশ আবৃত্তি ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি করা হয়েছিল তাঁকে। এ দেশে প্রাতিষ্ঠানিক আবৃত্তিচর্চার শুরু থেকে এ যাবৎ সব কর্মকাণ্ডে তাঁর সক্রিয় অনুপ্রেরণার অভাব হয়নি কোনোদিন। ওয়াহিদ ভাইয়ের লেখা কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে এ পর্যন্ত। সঙ্গীত, নাটক ও আবৃত্তি সব ক্ষেত্রেই একজন পারফর্মারের ভঙ্গিসর্বস্ব হওয়ার রীতিটিকে অপছন্দ করতেন চিরকাল। বাণীর মর্ম উপলব্ধির মাধ্যমে সত্য করে বলা এবং তাকে জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়ার তাগিদ দিতেন অনুসারীদের। শুধু আন্দোলন নয়, প্রকৃতই ব্রতচারী ছিলেন এই নিভৃতচারী মানুষটি।

ওয়াহিদুল হকের জীবনাবসানে এ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একটি অধ্যায়ের অবসান ঘটেছে। তাঁর অসংখ্য অনুসারী, অনুরাগী ও গুণগ্রাহী ছড়িয়ে রয়েছে সারাদেশে। দেশে-বিদেশে বান্ধবও রয়েছে প্রচুর। ওয়াহিদুল হকের উদ্দেশ্য সাধনে আজীবন ব্রতী হয়ে থাকবেন তাঁরা। কাছের মানুষ হয়েও দূরে চলে গেলেন তিনি। রেখে গেলেন অচঞ্চল কর্মধারা ও শুদ্ধ জীবনাচার। জীবনকে আনন্দময় করার সব মন্ত্রই তাঁর জানা ছিল। তাই নিজেকে বিলিয়েদিয়ে চলে গেলেন অনন্তের মাঝে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘বৃথা তারে প্রশ্ন করি, বৃথা তার পায়ে ধরি, বৃথা মরি কেঁদে, খুঁজে ফিরি অশ্রুজলে কোন অঞ্চলের তলে, নিয়েছে সে বেঁধে। ছুটিয়া মৃত্যুর পিছে, ফিরে নিতে চাহি মিছে, সে কি আমাদের? পলেক বিচ্ছেদে হায়, তখনি তো বুঝা যায়, সে যে অনন্তের’।